- মেহেরপুর চিত্র‘র শুক্রবারের সাহিত্য পাতা-
“কিছু স্মৃতি ভোলা যায় না”
-স্নেহা আফরোজ সুইটি, নীলফামারী।
প্রথম কবে তোমার জন্য আমার মনে ভালোবাসা ঠাঁই পেয়েছে জানা নেই, সেদিন কি তিথি, নক্ষত্র কি লগ্ন ছিলো? ভাবিনি কখনও, শুধু জানি দু‘জন দু’জনকে খুব করে চেয়েছিলাম! জীবনে অনেক বাঁধা অতিক্রম করে, অনেক চড়াই-উতরাই পার করে তোমাকে নিজের করে পেয়েছিলাম। ভাবতেই পারিনি আমাদের সম্পর্কটা এভাবে পূর্ণতা পাবে। খুশীতে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। খুব হাসি-খুশি আনন্দে কেটেছিলো দু‘জনের ছোট্ট সংসার। ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া গুলো,
হাসি-কান্না গুলো ভাগ করে নিয়েছিলাম হাসি মুখে!
“অনেক চড়াই-উতরাই পার করে তোমাকে নিজের করে পেয়েছিলাম। দু‘জনের ভালোবাসা যেন পূর্ণতা পেল। আর সেই পূর্ণতা হলো আমার গর্ভের সন্তান, দু‘জনের ভালোবাসার অস্তিত্ব আমাদের সন্তান। তুমি হবে বাবা আর আমি, আমি হবো মা! আমার গর্ভে সে আর নেই! পৃথিবীতে আসার আগেই হারিয়ে ফেললাম তাকে! কি যে নিদারুণ কষ্ট, কতো রাত কেঁদে-কেঁদে কখন যে সকাল হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।”
এভাবে বছর দু-এক ভালোই কাটলো আমাদের দাম্পত্য জীবন। হঠাৎ একদিন খুব অস্থির লাগতেছিলো, গাগুলিয়ে বমি হচ্ছিলো, মাথা ঘুরতেছিলো, কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিলাম না! ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো আমার স্বামী। ডাক্তার হাসি মাখা মুখে বললেন মিষ্টি নিয়ে আসুন। আপনারা বাবা-মা হতে চলেছেন। তখন কি যে আনন্দ লাগতেছিলো বলে বুঝাতে পারবো না! দু‘জনের ভালোবাসা যেন পূর্ণতা পেল। আর সেই পূর্ণতা হলো আমার গর্ভের সন্তান, দু‘জনের ভালোবাসার অস্তিত্ব আমাদের সন্তান। তুমি হবে বাবা আর আমি, আমি হবো মা!
সে কি আনন্দ দু‘জনের মনে। এভাবেই কেটে গেলো হাসিখুশি আর খুনসুটিতে সাতটি মাস! কিন্তু হঠাৎ একদিন নেমে এলো জীবনে অন্ধকার! আমার যখন আট মাস চলতেছিলো ঠিক তখন জানতে পারলাম, আমাদের ভালোবাসার অস্তিত্ব একটি ফুল যে তিল-তিল করে বড় হচ্ছে আমার গর্ভে সে আর নেই! পৃথিবীতে আসার আগেই হারিয়ে ফেললাম তাকে! কি যে নিদারুণ কষ্ট হচ্ছিলো! কি করে বুঝবে তোমরা? সন্তান হারানোর জ্বালা তোমরা কি জানো?
মৃত্যুর যন্ত্রণার থেকেও সন্তান হারানোর বিরহ যে কতো কঠিন! কতো যন্ত্রণাদায়ক তা শুধু ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারে।
দুটি আঁখি হতে বহমান অশ্রু নদীতে সর্বসমক্ষে সিক্ত হতে লাগলো আমার, স্বয়ং ঈশ্বরও এই দৃশ্য দেখে ব্যথিত হলেন। সন্তান হারানোর শোক কাটতে না কাটতেই সম্মুখীন হলাম আরও একটি কঠিন সত্যের। আমার শ্বশুর বাড়িতে আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসে না কেউ! সবাই যেনো উঠতে বসতেই কথা শুনাতে ব্যস্ত! তবুও দাঁতে -দাঁত চিপে সব কিছু সহ্য করে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুদিন পর যখন আমার স্বামীও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো! তখন আর নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে যেন অনবরত। আমার স্বামী আমাকে বাবার বাড়িতে পাঠানোর জন্য উঠে পড়ে লাগলো!
কিছুতেই আর শ্বশুর বাড়িতে রাখতে ইচ্ছুক নয় সে! এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে রাজি হলাম। নিজেকে সামলিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম!
রওয়ানা দিলাম স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সে আমার সাথে রেলস্টেশনে আসলো। ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বললো, তুমি কিছুদিন বাবার বাড়িতে যেয়ে ঘুরে আসো। আমি পরে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবো।
আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, মানুষটা আমাকে এতোটা ভালোবাসলো, সে আজ কীভাবে একা ছেড়ে দিলো আমাকে? এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের কোণে কখন যে জল চলে আসলো নিজেও জানি না! কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে নিলাম। কিন্তু তাকে কিছু বুঝতে দিলাম না। ট্রেন ছেড়ে দিবে এমন সময় সে আমার হাত ধরে বললো, চিন্তা করো না আমি তোমাকে নিয়ে আসবো কিছুদিন পর। কিন্তু সেই যে হাতটা ছেড়ে দিয়ে গেলো আর আসলো না ফিরে! কতো যে চেষ্টা করেছি যোগাযোগ করার। কিন্তু নিয়তি এমনই যে সময়ের উত্তাপে হৃদয়ের দাবানলে কখন যে দূরে সরে গেলাম দুজন বুঝতেই পারলাম না।
আমি তাকে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু ফেরাতে পারিনি! কতো রাত কেঁদে-কেঁদে কখন যে সকাল হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। এভাবেই কেটে গেলো কয়েক মাস। মাস পেরিয়ে কয়েকটি বছর। মনের জানালার ছিটকিনিটা বড়ই অশক্ত। এখনো পুরনো স্মৃতিরা হানা দিয়ে হৃদয় করে যায় তপ্ত! এখন প্রাপ্তির বাধ ভাঙা হাসিতে মেতে উঠে না আর এই মন! কিছু স্মৃতি ভোলা যায় না। অব্যক্ত স্বপ্নগুলো প্রাণ খুলে আর হাসে না। না পাওয়ার অভাবগুলো আজ বড়ই শব্দহীন। হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নীল স্বপ্নগুলো জানি আসবে না আর ফিরে! অপ্রত্যাশিত অনাবৃষ্টির ছিটায় হারিয়েছে আজ আবেগের শত শিহরণ। হারিয়ে যাওয়া সাত সমুদ্র ভালোবাসা আজ শুধুই বিস্মরণ।
তবে আমি চাই সে সুখী হোক এবং সুখে থাকুক আজীবন।
-স্নেহা আফরোজ সুইটি, নীলফামারী।