কিছু স্মৃতি কিছু কথা-
৬ ডিসেম্বর ‘৭১
-প্রফেসর মোঃ হাসানুজ্জামান মালেক; মেহেরপুর।
৬ ডিসেম্বর ‘৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী দেশত্যাগী লক্ষ লক্ষ শরনার্থীদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, আশ্রয় দিয়ে মানবতা দেখিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল যে ভারত; বাংলাদেশের হাজার হাজার দেশপ্রেমিক ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, অস্ত্র গোলা বারুদ দিয়ে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছিল যে ভারত; নানান প্রতিকূলতা ও ঝুঁকি নিয়ে নিজের ভূখন্ড ব্যবহার করতে দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ধাত্রীপনার কাজ করেছিল যে ভারত; এদিন সেই ভারত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিল, বাঙালি আজ জয়ের দ্বারপ্রান্তে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি বিশেষ মর্যাদার, স্বর্ণোজ্জ্বল ও স্মরণীয়।
৬ ডিসেম্বর মেহেরপুরবাসীর জন্যও এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে ইতিহাসের বর্বর, নৃশংস, উন্মাদ নরঘাতক পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল মেহেরপুর। কীভাবে হয়েছিল? তা জানতে হলে আমাদের একটু ইতিহাসচর্চা করতে হবে।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই পাকবাহিনী নাস্তানুবাদ হতে থাকে। মেহেরপুর শহরের চতুর্দিকে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হতে থাকে। উজলপুর, মনোহরপুর, গোভীপুর, যাদবপুর, মোনাখালি, বন্দর, আমঝুপি, বাড়াদি প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয়। উদ্দেশ্য ছিল, মেহেরপুর কলেজ ও ভোকেশনালে অবস্থিত পাকবাহিনীর ওপর একযোগে আক্রমণ চালানো হবে। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে পশ্চিম সেক্টরে পাকিস্তান ভারতের ওপর আক্রমণ চালায়। ভারত প্রতিহত করে এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ হয়। পরদিন ৮নং সেক্টরের ৭নম্বর সাব সেক্টরের ৩সি কোম্পানীর উপদেষ্টা এমএনএ ছহিউদ্দীন বেতাইয়ে ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর সাথে পরামর্শ করে ১প্লাটুন ইপিআর এবং ২০জন গেরিলা মোট ৫২ জনের এক দল পাঠায় আমঝুপি-বাড়াদি এলাকায়। যাতে পাকবাহিনী পালাতে না পারে। ওদিকে গাংনী এলাকাতেও মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকে।
ডিসেম্বরের ৫ তারিখে মেহেরপুরের উপকন্ঠে যাদবপুরের পশ্চিমে গোবরার খড়ের মাঠে ভারতীয় বাহিনীর ৭নং বিগ্রেডের ৫নং জাট রেজিমেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধাদের এক বিশাল বহর উপস্থিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক বিগ্রেডিয়ার জৈল সিং এর নেতৃত্বে ৬ তারিখে মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করবে মিত্রবাহিনী। এ খবর পেয়ে বিগ্রেডিয়ার মঞ্জুরের নির্দেশে পাকবাহিনী ৬তারিখ রাত ৮টার পর থেকেই পালাতে শুরু করে। ১৮ এপ্রিল যে আমঝুপিতে গণহত্যা চালিয়ে মেহেরপুর প্রবেশ করেছিল পাকবাহিনী সেই আমঝুপি-বাড়াদীতেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে মেহেরপুর ত্যাগ করে। পলায়নকালে তারা এতটাই ভীত সন্ত্রস্ত ছিল যে আমঝুপি হাটের কাছে নিজেদের গাড়ির মধ্যে ধাক্কা লেগে বিধ্বস্ত হয়ে আহত-নিহত, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মেহেরপুর থেকে পালিয়ে যায় পাকবাহিনী। মেহেরপুর হয় মুক্ত।
৭ডিসেম্বর সকালে বিগ্রেডিয়ার জৈল সিং এর নেতৃত্বে ৫নং জাট রেজিমেন্ট এবং ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশাল বাহিনী প্রবেশ করে মেহেরপুরে। ক্যাপ্টেন ইয়াদু মেহেরপুর কলেজে পতাকা তুলে মুক্তির বারতা ছড়িয়ে দেন। মেহেরপুর শহর জেগে ওঠে আনন্দে। কেমন ছিল সেদিনের সকালটি ? আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। নন্দনপুর শরণার্থী ক্যাম্প থেকে কিছুদিন হল কাগজেপাড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে স্থানান্তরিত হয়েছি। হালকা অস্ত্র চালনা শিখে নিয়েছি।
৬ ডিসেম্বরের মধ্যরাত। কাথুলী সীমান্তে ভৈরবের ধারে ভারতীয় ভূখন্ডের কাগজেপাড়া নামক স্থানে জীর্ণ শীর্ণ এক চালাঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। হঠাৎ জেগে উঠল ক্যাম্পটি। দ্রুত সবাই অস্ত্র গোলা বারুদ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মামা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কাশেমের নির্দেশে একটি স্টেনগান নিয়ে আমিও সঙ্গী হলাম তাদের। কাথুলী হয়ে গাঁড়াবাড়িয়ার রাস্তা ধরে মেহেরপুর অভিমুখে যাত্রা। দেখেছি কুয়াশা ভেদ করে শীতের সকালে উদিত সূর্যটি যেন লাল টকটকে গোলক। কুয়াশার অবগুণ্ঠন ছিড়ে নিস্তব্ধতার বুক চিরে হেঁটে চলেছি, শীতের কনকনে ঠান্ডায় শরীর কাঁপলেও হৃদয়ের উষ্ণতার কাছে তা উপেক্ষণীয়। দেখেছি, টিনের চালে, গাছের ডালে, ঘাসের ডগায়, শিশির বিন্দু জমে আছে মুক্তার মত জ্বলজ্বল করছে। দেখেছি, শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে বন্দীশিবির থেকে মুক্ত হওয়া রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা । দেখেছি মুক্ত মানুষের বাঁধভাঙা উল্লাস, দিকে দিকে জয়বাংলা জয়ধ্বনি । দেখেছি যুদ্ধ জয়ের গৌরবে উদ্ভাসিত অদম্য মুক্তিসেনার দল। দেখেছি, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে মুক্ত বিহঙ্গ। দেখেছি, হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশ।
-লেখকঃ প্রফেসর মোঃ হাসানুজ্জামান মালেক; সভাপতি বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ, মেহেরপুর জেলা শাখা।