- মেহেরপুরে তৈল জাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদন
- সরিষা’র বাম্পার ফলন কৃষকের মুখে মিষ্টি হাসি
- তৈল জাতীয় ফসলের চাষাবাদ বাড়াতে মেহেরপুরস্থ বিএডিসি’র ফসলের নতুন জাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পরীক্ষার জন্য ট্রায়াল চলছে
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ মেহেরপুরের অনাবাদি পতিত জমিতে সরিষা’র বাম্পার ফলন কৃষক এখন বেজায় খুশি। মেহেরপুর জেলায় মেহেরপুরে ১৮৭ হেক্টরে খামার ও চুক্তিবদ্ধ চাষীর জমিতে ১৯৭ মে.টন তৈল জাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদন করা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যার মধ্যে ৯২ হেক্টরে শুধুমাত্র সরিষা। বর্তমানে আমাদের দেশে ৫.৬০ লক্ষ হেক্টর জমি থেকে ৪.৮০ লক্ষ মে.টন বীজ এবং ২.০৩ লক্ষ মে. টন ভোজ্য তৈল উৎপাদন হচ্ছে। ফলে দেশের মোট চাহিদার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ তৈল দেশে উৎপন্ন হয়। গত মাসে মেহেরপুর সফরকালে কৃষিবিদ মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড.আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন- দেশে বছরে চাহিদার ৯০ শতাংশ ভোজ্য তৈল আমদানী করতে হয়। এতে প্রতি বছর ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। স্থানীয় ভাবে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১০শতাংশ। তাই আগামী ৩বছরের মধ্যে চাহিদার ৪০-৫০ভাগ ভোজ্য তৈল উৎপাদনের রোড ম্যাপ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন এবং তৈলের এই ঘাটতি পূরণের জন্য দেশে যুগোপযোগী কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তিতে উন্নত জাতের তৈল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি কল্পে বিএডিসি’র পক্ষ থেকে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধকরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলা আমঝুপি সরিষার চাষী খায়রুজ্জামান টুটুল বলেন- ১০একর সরিষা চাষ করেছে আশা করা যায় ভালো ফলন পাওয়া যাবে। সরিষা চাষী কিতাব আলী বলেন- ১২একর সরিষা চাষ করেছেন আবহাওয়া (ওয়েদার) ভালো, সরিষার তৈলের চাহিদা আছে কৃষকরা সরিষা চাষে লাভবান হচ্ছে ও হবে।
মেহেরপুর আমঝুপি বিএডিসি ডাল তৈল বীজ খামারের প্রসেসিং এর উপ-পরিচালক জিয়াউর রহমান বলেন- ডাল ও তৈল বীজ বিভাগের প্রধান যুগ্ম পরিচালক কৃষিবিদ একেএম নূরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় ও গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণের ফলে গত ২০২১-২২ বর্ষে শুধুমাত্র মেহেরপুরে যেখানে ১৮৭হেক্টরে খামার ও চুক্তিবদ্ধ চাষীর জমিতে ১৯৭মে.টন তৈল জাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদন করা হয়। যার মধ্যে ৯২হেক্টরে শুধুমাত্র সরিষা থেকে পাই ১০০.০১০ মে.টন বীজ। সেখানে এবার চলতি ২০২২- ২৩ বর্ষে ৩১৫হেক্টর জমিতে ৩৬৭মে.টন বীজ উৎপাদনের মধ্যে শুধুমাত্র সরিষাতেই ১৪৬ হেক্টরে ১৬১ মে.টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় শুধু সরিষাতেই শতকরা ১৬১ভাগ বেশী, যেটা এক অনন্য অগ্রগতি।
মেহেরপুরের আমঝুপি ডাল ও তৈল ভিত্তি বীজ উৎপাদন খামারের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সঞ্জয় দেবনাথ বলেন- বাংলাদেশে সরিষা বীজের বর্তমান কৃষিতাত্ত্বিক চাহিদা ৪১৭৯ মে.টন। তারমধ্যে বিএডিসি’র খামার ও চুক্তিবদ্ধ চাষীর মাধ্যমে উৎপাদন ও সরবরাহ করা হয় মাত্র ১১৮৫ মে. টন, যা চাহিদার মাত্র ২৮%। কাজেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী দেশে যে ৫৬লাখ হেক্টর জমিতে আমন ও বোরো ধান চাষ হয়ে থাকে তার মাঝে দীর্ঘ মেয়াদী ধানের জমি উৎপাদনের জন্য আবদ্ধ হয়ে থাকলেও স্বল্প মেয়াদী ধান উৎপাদনের পর প্রায় ২০লাখ হেক্টর জমি ৭০-৮০ দিনের জন্য পতিত থাকে। যে জমিতে- “স্বল্প মেয়াদী আমন ( যেমন- বিনা ধান৭, ব্রিধান৭৫) – স্বল্প মেয়াদী সরিষা (যেমন বারি সরিয়া৯, ২৪, ১৮) – স্বল্প মেয়াদী বোরো ধান (যেমন- বঙ্গবন্ধু ধান১০০, ব্রি ধান৬৭, ৬৮, ৮১,৮৪, ৯৬, বিনা ধান ১০,২৪)” এমন শস্যবিন্যাসের মাধ্যমে চাষাবাদ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশনা (“কোন জমি পতিত রাখা যাবে না”) পালনের পাশাপাশি পতিত জমিরও হচ্ছে উল্লেখযোগ্য সদ্ব্যবহার। এতে করে একটা বাড়তি ফসল প্রাপ্তির পাশাপাশি দ্বি-ফসলী জমি হবে ত্রি-ফসলী এবং ত্রি-ফসলী জমি হবে চার-ফসলী। এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন এমপি উৎসাহের সাথে জানান, আমন-বোরোর মাঝে বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষা চাষের উদ্যোগ গ্রহণকে অত্র এলাকার চাষীরা স্বাগত জানিয়েছে, পাশাপাশি একটা বাড়তি ফসল পাওয়ায় তারা খুব খুশী। তাদের ফসল উৎপাদনের নিবিড়তাও ২০০% থেকে একবারে ৩০০ বা ৪০০%-এ উন্নীত হয়েছে, বেড়েছে তাদের আয়। এতে চাষীদের কাঙ্খিত ফসল উৎপাদনে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি এবং সরিষাতে ৪-৬ভাগ নাইট্রোজেন থাকায় মাটির উর্বরতারও কোন ঘাটতি হয়নি। কৃষিবিদ সঞ্জয় কুমার দেবনাথ বলেন- তৈল জাতীয় ফসলের চাষাবাদ বাড়াতে মেহেরপুরস্থ বিএডিসি’র অত্র ভাল ও তৈল বীজ উৎপাদন খামারের মূল কার্যক্রম সরিষা, সয়াবিন, সূর্যমুখী’র বীজ উৎপাদনের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়ান তৈলবীজ ফসল পেরিলা, তিসি এবং ১৩টি হাইব্রিড ও ২টি মোট ১৫টি দেশী ও বিদেশী জাতের সূর্যমুখীর উৎপাদনশীলতা পরীক্ষার জন্য ট্রায়াল করার লক্ষ্যে এটা স্থাপন করা হয়েছে। যে জাতগুলোর ফলন ভাল পাওয়া যাবে সেগুলো আগামী বছর উৎপাদনে যাবে। অবতারনা হবে তৈলজাতীয় ফসল উৎপাদনের আরও এক নতুন অধ্যায় আশা করা যাচ্ছে।
বিএডিসি’র মেহেরপুরের বারাদী বীজ উৎপাদন খামারের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মনিরুজ্জামান বলেন- বাংলাদেশে স্বল্প আবাদী জমির মধ্যে শতকরা ৮০ভাগই ধান, গম ইত্যাদি দানাদার ফসল চাষাবাদ হলেও মাত্র ৩-৫% জমিতে তৈল জাতীয় ফসল চাষাবাদ হয়ে থাকে। ফলে জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ পুষ্টিহীনতার স্বীকার হয়। দৈহিক ও মানষিক বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ, রোগ প্রতিরোধ এবং মেধা ও কর্মশক্তির উৎস হিসেবে দানাদার খাদ্যের সাথে দৈনিক তৈল জাতীয় খাদ্য গ্রহণ অতীব জরুরী। কেননা পুষ্টিচাহিদা অনুযায়ী তৈল আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার অপরিহার্য অংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র রিপোর্ট অনুযায়ী সুস্থ থাকার জন্য একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ২২গ্রাম তৈল/চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন হলেও আমরা গ্রহণ করি মাত্র ১০গ্রাম।