“৬ডিসেম্বর মেহেরপুর মুক্ত দিবস। মেহেরপুর মুক্ত দিবস। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে দাঁড়াতে না পেরে হানাদার বাহিনীরা জেলাটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। মেহেরপুরবাসী পায় স্বাধীন ভূমি। আনন্দ আর উল্লাস করতে করতে সর্বস্তরের মানুষ নেমে আসে রাস্তায়।”
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ আজ ঐতিহাসিক ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত হয় মেহেরপুর জেলা। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায় ভেঙ্গে পড়ে পাক হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী সামরিক বলয়। ৫ ডিসেম্বর রাত থেকেই গোপনে মেহেরপুর ছাড়তে শুরু করে পাক বাহিনী। ৬ ডিসেম্বর সকালে মিত্র বাহিনী মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করলে অবরুদ্ধ জনতা মিত্র বাহিনীর সঙ্গে জয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে।
মেহেরপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যমতে , ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের পর হানাদার বাহিনীর টার্গেটে পড়ে মেহেরপুর। ১৮ এপ্রিল দুপুরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে সড়ক পথে মেহেরপুর আসতে থাকে। এ সময় বর্তমান সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালায়। ফলে এ অঞ্চলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যতঃ ভেঙ্গে পড়ে। ভীত সন্ত্রস্ত জনসাধারণ ঘর-বাড়ি ছেড়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নেয়। তখন ভারতের হৃদয়পুর, বেতাই, শিকারপুর, করিমপুর, কাচুলিয়া, বিহার সহ বেশ কয়েটি জায়গায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। ভারতীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশী যুব সমাজ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। প্রথম অবস্থায় কাঙ্খিত পরিমাণ অস্ত্র না পাওয়ায় তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। তবে দেশকে হানাদার মুক্ত করতে অনেকেই দেশে এসে ক্যাম্প লুট করে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। আরও বলেন, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মেহেরপুর সরকারি কলেজ, ভোকেশনাল এবং কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলসহ তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাক বাহিনীরা শক্তিশালী দুর্গ গড়ে তোলে। এছাড়াও মেহেরপুর মহাজনপুরের পাশে চুয়াডাঙ্গার নাটুদা হাইস্কুলে পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। মে মাসের মাঝামঝি সময়ে গোটা মেহেরপুর জেলা পাকবাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। জুন-জুলাই মাসের দিকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলারা এসে সেতু কার্লভাট ধ্বংস এবং টেলিফোন সংযোগ বিছিন্ন করে মাইন পুতে রেখে পাক বাহিনীদের যোগাযোগ এবং খাদ্য সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। আগষ্ট মাসের ২ ও ৩ তারিখে মানিকনগর ক্যাম্প উঠিয়ে মোনাখালিতে এবং কাথুলি ক্যাম্প উঠিয়ে গাংনীর ভাটপাড়াতে স্থাপন করতে বাধ্য হয় পাকবাহিনী।
মেহেরপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে জানতে পারি, দীর্ঘ সময় ধরে পাকসেনারা রাজাকারদের সহায়তায় সাধারণ মানুষ সহ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের উপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালাতে থাকে। পাকসেনারা আমঝুপি, ওয়াপদা মোড়, পিরোজপুর, বুড়িপোতা, গোভীপুর, শালিকা, রাজাপুর, কাজিপুর, তেরাইল, জোড়পুকুরিয়া, বাগোয়ান-রতনপুর, ভাটপাড়া কুঠি, সাহেবনগর, কোলা, হিন্দা ও বাড়িবাঁকা সহ বিভিন্ন গ্রামে নৃশংস গণহত্যা চালায়।
আরও বলেন, যেখানেই গণহত্যা সেখানেই বধ্যভূমি রয়েছে। মেহেরপুরে অন্তত ১৫টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। তার মধ্যে মেহেরপুর সরকারি কলেজের উত্তরের খোলা মাঠ, কালাচাঁদপুর খালের ঘাট (স্থাপিত হয়নি), তাহের ক্লিনিকের পূর্বদিক, ও ভাটপাড়া কুঠি অন্যতম বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধ চলা কালিন খলিশাকুন্ডি, গোয়ালগ্রাম, সাহেবনগর, কাজিপুরসহ অন্তত ৫০ টি স্থানে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ১৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেও মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়ে পাকবাহিনী।
“৫ডিসেম্বর বিকেলে জেলার বিভিন্ন দিক দিয়ে পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ করা হয়। অপর আক্রমণটি করা হয় মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের বামুন্দিতে। অবস্থা বেগতিক দেখে ৫ ডিসেম্বর রাত থেকেই পাক বাহিনী মেহেরপুর থেকে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার দিকে পিছু হঠতে শুরু করে। আর কুষ্টিয়া সড়কের খলিশাকুন্ডি দিয়ে পালিয়ে যায় পাক বাহিনী। যাওয়ার সময় আমঝুপি দ্বিনদত্ত ব্রিজ, ওয়াবদাসহ বহু গুরত্বপূর্ণ স্থান ধ্বংস করে দিয়ে যায়। ৬ ডিসেম্বর সকালে আর কোনো পাক বাহিনীর সদস্যকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুক্ত হয় প্রথম অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদানকারী আনসার সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ বলেন, চুড়ান্ত বিজয়ের লক্ষে ৫ডিসেম্বর কড়ইগাছি, রাইপুর-শিমুলতলা, কুঞ্জনগর, ঝোড়পাড়া, সহড়াবাড়িয়া, বুড়িপোতা, মুজিবনগর দিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমনে পিছু হটতে থাকে। কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে শুকুরকান্দি নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পিতভাবে আক্রমন করলে বেশ ক’জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত চতুর্মুখী হামলায় ভাটপাড়া ক্যাম্পের পাকসেনারাও পালিয়ে যায়। ৬ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার জৈল সিংয়ের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর বিশাল বহর মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করে। তার পূর্বেই পাকবাহিনীরা মেহেরপুর ছেড়ে চুয়াডাঙ্গা হয়ে কুষ্টিয়া পালিয়ে যায়। মেহেরপুর হয় হানাদার মুক্ত।
এদিকে ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর মুক্ত হওয়ায় দিনটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় দিনটি পালনে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল আলোচনাসভা, র্যালীসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।